মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:৪৩ অপরাহ্ন

বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা

বাংলা সাহিত্য প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে। চর্যাপদের সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন। বাংলা ভাষা রচিত সাহিত্য বাঙালি কবি ও লেখকদের হাতে সৃজনশীল সৃষ্টি বা শিল্প হয়ে উঠেছে। চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, বৈষ্ণব সাহিত্য, মৈমনসিংহ গীতিকা, দোভাষী পুঁথিসাহিত্য, ও আধুনিক সাহিত্য মিলিয়ে সাহিত্যের নানা উপাদানে বাংলা সাহিত্য অন্যতম সাহিত্যধারা হিসেবে বিকশিত হয়েছে। কবিতা, নাটক, গান, গাথা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি শাখার সমবায়ে বাংলা সাহিত্য অজস্র লেখকের সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর ধারায় উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রচিত সাহিত্যকে তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কয়েকটি ধারায় বিভক্ত করা হয়। প্রাচীনযুগের সীমা হলো ৬৫০ খ্রীঃ থেকে ১২০০ খ্রীঃ, মধ্যযুগের সীমা হলো ১২০১ খ্রীঃ থেকে ১৮০০ খ্রীঃ। আর আধুনিকযুগের সময়কাল ধরা হয় ১৮০০ খ্রীঃ থেকে বর্তমান পর্যন্ত। প্রাচীন যুগের শুরু ৬৫০ খ্রীঃ এই মতটি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র। তিনি তিব্বতি চর্যাপদের হিসেবে শবরপাকে ৬৮০ খ্রীস্টাব্দে জন্ম ধরে এই কাল নির্ধারণ করেছেন। বাংলায় বৌদ্ধদের ধর্ম প্রচারের বা প্রসারের সময়ও এখানে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। অবশ্য অনেক পন্ডিত শহীদুল্লাহ-র এই মতকে সমর্থন করেন নি। তাদের মতে প্রাচীনযুগ শুরু হবে ৯৫০ খ্রীস্টাব্দ থেকে। ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রীঃ পর্যন্ত সময়কে কোন কোন পন্ডিত অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করেন। তাদের ধারণা এসময়ে কোন সাহিত্য রচিত হয়নি। তাই এ সময়কাল হলো অন্ধকার যুগ। প্রকৃত প্রস্তাবে এসময় অন্ধকার যুগ নয় কারণ এসময়েও কিছু রচনা পরবর্তীকালে পাওয়া গেছে। এসময় তুর্কিরা বাংলা দখল করেছিল এবং সে কারণে সমাজে নানা রকম বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। এসময়ে খুব বেশি সাহিত্য রচিত হয়নি এরকম অনুমান করা হয়। আর হলেও তা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়। মধ্যযুগে রচিত সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। কবিয়াল শ্রেণির লেখকগণ মধ্যযুগের শেষের দিকে কাব্য রচনা করেছেন যা গাওয়া হতো। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হয় ইংরেজদের আগমনের সূত্র ধরে। ১৮০০ সালে কোলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তৈরি করেন ইংরেজরা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নেটিভদেরকে শিক্ষিত করে কেরানি তৈরি করা এবং দেশ পরিচালনায় তাদের ব্যবহার করা। এভাবেই ইউরোপীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ও তার প্রভাব এদেশের শিক্ষিত জনগণের ওপর পড়ে। পরবর্তীকালে আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই আধুনিকতার অন্যতম প্রতীক। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ ব্যক্তিরা মিলে বাংলায় যে নবজাগরণ এনেছিলেন তার প্রভাব পড়ে আমাদের সাহিত্যে। এঁরা নিজেরাও সাহিত্যিক ছিলেন। হাজার বছরের পয়ার ছন্দে রচিত কবিতা মধুসুদনের হাতে পরিবর্তন হলো। সাহিত্যে মানুষ এলো কেন্দ্রে। ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদের ছোঁয়া লাগল বাংলা সাহিত্যে। নারীকে পাওয়া গেল স্বাধীন সত্তাসহ। প্রতিটি পর্বের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য রয়েছে, আছে যুগ ও ইতিহাসের নানা সাক্ষ্য। আর আছে সাহিত্যে নানা রকম গঠনগত পরিবর্তন। যুগবিভাগের হিসেব মতো এখনো আধুনিক কাল চলছে। তবে অনেকের ধারণা আধুনিক যুগ শেষ হয়ে গেছে এবং শুরু হয়েছে উত্তরাধুনিক যুগ। যদিও উত্তরাধুনিকতা কোন যুগ বিভাগের ধারণায় পড়ে না। কারণ এটা একটি আন্দোলন যার সাথে শুধু সাহিত্য সম্পর্কিত নয়, এর সাথে মিশে আছে ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞান। আমাদের দেশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কালে কোলকাতায় কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে সাহিত্যধারার সূচনা হয় তাকে কল্লোল যুগ বলা হয়। সে সময় রবীন্দ্রনাথ জীবিত ছিলেন। এই গোষ্ঠি রবীন্দ্রনাথের ভাববাদী সাহিত্যচিন্তার বিপরীতে অবস্থান করেছিলেন। তারা মাটি ও মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন সাহিত্যকে। এই আধুনিকতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। গ্লোবাল ভিলেজের যুগে বাংলা সাহিত্য বর্তমানে শুধু উত্তরাধুনিকতা নিয়েই ব্যাপৃত নয় বরং সারা পৃথিবীর নানা ধারার সাহিত্য প্রবণতা ও জীবন বৈচিত্রকে যুক্ত হচ্ছে এর সাথে। এ যুগের নানা চিন্তকদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছেন মিশেল পল ফুকো, এডয়ার্ড সাইদ, নোম চমস্কি, জ্যাক দেরিদো প্রমুখ।


পোস্টটি শেয়ার করুন...

© BengaliGrammar.Com
Maintenance by BengaliGrammar.Com