মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন

ভাষার উপাদান ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার ধ্বনির শ্রেণীকরণ স্বরসন্ধি ব্যঞ্জনসন্ধি বিসর্গ সন্ধি

ভাষার উপাদান কয়টি ও কি কি? প্রত্যেক ভাষার কতকগুলো উপাদান থাকে, যা নির্দিষ্ট। বাংলা ভাষার উপাদান তিনটি যথা- ১. ধ্বনি/বর্ণ ২. শব্দ ৩. বাক্য। ধ্বনি বা বর্ণ সংক্রান্ত আলোচ্য বিষয়কে ধ্বনিতত্ত্ব, ধ্বনি প্রকরণ বলা হয়। ইংরেজিতে Phonology। আবার ধ্বনির শুধুমাত্র উচ্চারণ নিয়েও আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়। একে Phonetics বলা হয়।

রূপতত্ত্ব কাকে বলে? শব্দ ভাষার অন্যতম মৌলিক উপাদান। ধ্বনির সমষ্টিই শব্দ ও পদ। শব্দ নিয়ে যাবতীয় আলোচনাকে শব্দ প্রকরণ বলা হয়। বাক্যের মধ্যে শব্দ বা পদ কিভাবে ব্যবহৃত হবে তার আলোচনা হয় রূপতত্ত্ব নামক বিষয়ে। শব্দের গঠন, উৎপত্তি, ব্যবহার এর আলোচ্য বিষয়। রূপতত্ত্ব (Morphology) প্রকৃত অর্থে ব্যাকরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বাক্যতত্ত্ব কাকে বলে? বাক্য সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনাকে এক কথায় বাক্যতত্ত্ব (Syntex) বলে। এতে বাক্যের গঠন, প্রকারভেদ, সঠিক বাক্য, তার গুণাবলী ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়।

ধ্বনিতত্ত্ব কাকে বলে? এর উপাদান কী কী? ভাষার ক্ষুদ্রতম উপাদান ধ্বনি (phone)। সাধারণ ধ্বনি (Sound) ও ভাষার ধ্বনির মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে, উভয় ধ্বনিই কম্পনের (Vibration) সাহায্যে তৈরি হয়। কম্পনের ফলে বাতাসে যে নিনাদ তৈরি হয় তা-ই ধ্বনি। অন্যদিকে কোন ভাষার উচ্চারিত শব্দকে বিশ্লেষণ করলে যে ক্ষুদ্রতম একক পাওয়া যায় তা-ই ধ্বনি (phone)। এই ক্ষুদ্রতম একক অবিভাজ্য, অর্থাৎএকে আর বিভক্ত করা যায় না। বাংলা ভাষার কয়েকটি ধ্বনি হল, অ, ক, খ, চ, ঝ ইত্যাদি। ‘রাখাল’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়- রাখ + আল > আ + ল > র + অ + খ + অ > আ + ল + অ।

অর্থাৎ র, অ, খ, ল, আ সব ধ্বনি। বাংলা ভাষার অন্যতম সদস্য। আপাতভাবে এদেরকে ধ্বনি বললেও এসব আসলে বর্ণ। অর্থাৎ অ ধ্বনির সাংকেতিক রূপ হল ‘অ’। অর্থাৎ ধ্বনির দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রতীক বা চিহ্নকে বর্ণ (letter) বলে। ‘ক’ ধ্বনি আমরা মুখে উচ্চারণ করি, অন্যেরা শোনে। কিন্তু যারা লেখাপড়া জানে, তাদের জন্য ‘ক’ ধ্বনির একটা লিখিত রূপ রয়েছে। অক্ষর জ্ঞানহীন ব্যক্তির কাছে ‘ক’ এই চিহ্নের দ্বারা কিছুই নির্দেশিত হয় না।

অক্ষর কাকে বলে? একটি শব্দ উচ্চারণের সময় নিঃশ্বাসের যে ছেদ ঘটে অর্থাৎ শব্দটি যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায় তাকে অক্ষর (Syllable) বলে। যেমন- ‘কম্পন’ শব্দটি কম + পন এই দুটি অক্ষর বা সিলেবলে বিভক্ত। বাংলায় বর্ণকেও অক্ষর বলা হয়। বাংলা বর্ণমালায় প্রতিটি বর্ণকেও অক্ষর বলা হয়। তবে, কার্যত অক্ষর আলাদা।

ধ্বনির প্রকারভেদ: বাংলা ভাষার ধ্বনিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। ইংরেজি ভাষাতেও ধ্বনি দু’প্রকার। যথা- স্বরধ্বনি (Vowel) ও ব্যঞ্জনধ্বনি (Consonant)। ধ্বনির পার্থক্য হয়ে যায় উচ্চারণ-পদ্ধতিগত কারণে। পূর্বে ধারণা করা হত, যে ধ্বনি কারো সাহায্য না নিয়ে নিজে নিজে উচ্চারিত হতে পারে, তাকে স্বরধ্বনি বলে। অন্যদিকে যে ধ্বনি অন্যের সাহায্যে ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না, তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। এই ধারণা সঠিক নয়, বলা যায় আংশিকভাবে ঠিক। ‘অ’ স্বরধ্বনি নিজে নিজে উচ্চারিত হয়, আবার ব্যঞ্জনধ্বনি ‘ক’ উচ্চারিত হতে ‘অ’ ধ্বনির সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না। তবে, এর ব্যতিক্রম আছে।

স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির সংঞ্জা: আধুনিক কালে ভাষাতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে বলা হয় ফুসফুসতাড়িত বাতাস গলনালী, মুখবিবর দিয়ে বের হবার সময় (ধ্বনি উচ্চারণে) যখন কোথায় বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় তা-ই স্বরধ্বনি। অর্থাৎ অ, আ, ই, উ, এ, ঐ ইত্যাদি স্বরধ্বনি। অন্যদিকে যে ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ফুসফুসতাড়িত বাতাস গলনালী বা মুখগহ্বরের অন্য কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয় তা-ই ব্যঞ্জনধ্বনি।

মৌলিক স্বরধ্বনি কাকে বলে ও এর উদাহরণ: বাংলায় মোট ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে। তবে, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এর মধ্যে সবগুলো মৌলিক নয়। অর্থাৎ কতকগুলো বর্ণের উচ্চারণ মূলত একই রকম। সাধারণত হ্রস্ব ও দীর্ঘ উচ্চারণের জন্য আলাদা বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- ই ও ঈ। মূলত মৌলিক স্বরধ্বনি ‘ই’। এর সাথে জোর বা দীর্ঘতা বোঝানোর জন্য ‘ঈ’ ধ্বনি তৈরি করা হয়েছে। কাজেই একই জাতীয় উচ্চারণের প্রথম বা আদি স্বরধ্বনিই মৌলিক। বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনি ৭টি। এগুলো হলো- অ, আ, ই, উ, এ, এ্যা, ও।

বাংলা বর্ণমালার পরিচয়: স্বরবর্ণ- অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ। বর্তমানে ঋৃ, ৯ বাংলা বর্ণমালা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। কার্যত এর কোন প্রয়োজন নেই। ব্যঞ্জনবর্ণ- ক, খ, গ, ঘ, ঙ; চ, ছ, জ, ঝ, ঞ; ট, ঠ, ড, ঢ, ণ; ত, থ, দ, ধ, ন; প, ফ, ব, ভ, ম; য র, ল, ব (অন্তঃস্থ ব); শ ষ স হ ং ঃ ।

কার কাকে বলে? স্বরবর্ণ বাংলা শব্দে দু’ভাগে ব্যবহৃত হয়। স্বরবর্ণের স্বাভাবিক প্রতীকের বাইরে অন্য আর একটি প্রতীক রয়েছে। ‘অ’ বর্ণ বাদ দিয়ে প্রতিটি বর্ণের এই প্রতীক শব্দে ব্যবহৃত হয়। ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রেও রয়েছে, তবে তা সীমিত। স্বরবর্ণের এই সংক্ষিপ্ত রূপকে ‘কার’ বলে। যেমন- আ = া, ই = ,ি ঈ = ী, উ = ু , ঊ = ূ , ঋ = ৃ , এ = ,ে ঐ = ,ৈ ও = -ো, ঔ = -ৌ।

ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার

ফলা কাকে বলে? কতকগুলো ব্যঞ্জনবর্ণ অন্য ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে একত্রিত হয়ে উচ্চারিত হয়। কখনো নিজস্ব ধ্বনিগুণ হারিয়ে ফেলে, কখনো বজায় থাকে। একে ফলা বলে। যেমন- বিশ্বাস। এখন ‘শ’ এর নিচে ‘ব’ ছোট করে ব্যবহৃত হয়েছে, এটাই ‘ব’ ফলা। অর্থাৎ তালব্য শ ব ফলা। এছাড়া কিছু ব্যঞ্জন সংক্ষিপ্তভাবে স্বরবর্ণের মত ছোট্ট প্রতীকে ব্যবহৃত হয়। যেমন- ঃ,র্ (বিসর্গ ও রেফ)। ‘বর্বর’ শব্দের র্ চিহ্নটি র বর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ। ‘্য’ অন্য আরেকটি উদাহরণ। ‘্য’ চিহ্নটি ‘য’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। আশ্চর্যের বিষয় য ও ‘্য’ (য ফলা) র উচ্চারণ একরকম নয়। য দিয়ে ‘যাচ্ছে’ বা ‘যায়’ শব্দ তৈরি হয়, ‘্য’ দিয়ে সহ্য, ব্যবসায়, বিদ্যা ইত্যাদিতে ‘্য’ এর উচ্চারণ ‘য’ এর মত নয়।

যুক্তাক্ষর কাকে বলে ও এর উদাহরণ: মানুষ তার বাকযন্ত্র দিয়ে বিচিত্র প্রকার ধ্বনি উচ্চারণ করে তার সবটা বাংলা বর্ণমালার মৌলিক স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনি বা অক্ষর দিয়ে লেখা সম্ভব নয়। ইংরেজি ভাষায় ২৬টি অক্ষর দিয়ে সব উচ্চরণ লেখা যায়। তবে নানা অসংগতিও থেকে যায়। একেকটি বর্ণের নানামাত্রিক উচ্চারণ পাঠককে সংকটে ফেলে। বাংলায় অসংগতি নেই বলা যাবে না। তবে পরিমাণে কম। উচ্চারিত প্রতিটি ধ্বনিকে বর্ণের আওতায় আনতে ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত করে ব্যবহার করা হয়-তাকেই যুক্তাক্ষর বলে। যেমন- ক্ল -ক+ল = ক্লান্ত।

ধ্বনির শ্রেণীকরণ

ধ্বনি কিভাবে উৎপন্ন হয়? বাগধ্বনি (অর্থবোধক ধ্বনি যা মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উৎপন্ন হয়) বা বাকধ্বনি মানুষের বাকযন্ত্রের সাহায্যে উৎপন্ন হয়। ফুসফুস, স্বরযন্ত্র, স্বরতন্ত্রী, গলনালী, মুখগহ্বর, জিহ্বা, নাক, তালু, মূর্ধা, ঠোঁট বা ওষ্ঠ এসব প্রত্যঙ্গের সাহায্যে বাকধ্বনি তৈরি হয়। ফুসফুস তাড়িত বাতাস বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের সংস্পর্শে আসে, বাতাস কখনো জোরে কখনো ধীরে যায়, কখনো ঘর্ষণ লাগে- এসব কারণে ধ্বনির নানারকম বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এসবের উপর ভিত্তি করে বাংলা ধ্বনিকে বেশ কিছু গ্রুপে বিভক্ত করা হয়।

অল্পপ্রাণ ধ্বনির পরিচয়: ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণের সময় ফুসফুস তাড়িত বাতাসের চাপ কম থাকলে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় তাকে অল্পপ্রাণ ধ্বনি (Unaspirated) বলে। সাধারণত বর্গের প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম ধ্বনিকে অল্পপ্রাণ ধ্বনি বলা হয়। বর্গের পঞ্চম ধ্বনি অবশ্য নাসিক্যধ্বনির অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণ : ক, গ, চ, জ, ট, ড, ত, দ, প, ব।

মহাপ্রাণ (Aspirated) ধ্বনির পরিচয়: যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস তাড়িত বাতাসের চাপ অধিক থাকে তাকে মহাপ্রাণ ধ্বনি বলে। সাধারণত বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনিগুলো মহাপ্রাণ ধ্বনি। উদাহরণ- খ, ঘ, ছ, ঝ, ঠ, ঢ, থ, ধ, ফ, ভ।

ঘোষধ্বনির সংজ্ঞা ও উদাহরণ: যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় স্বরতন্ত্রীতে স্পর্শ লাগে অর্থাৎ স্বরতন্ত্রী কেঁপে উঠে তাদেরকে ঘোষধ্বনি (Voiced Sounds) বলে। বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ বা ধ্বনিকে ঘোষধ্বনি বলে। উদাহরণ : গ, ঘ, ঙ, জ, ঝ, ঞ, ড, ঢ, ণ, দ, ধ, ন, ব, ভ, ম।

অঘোষ ধ্বনির সংজ্ঞা ও উদাহরণ: যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় স্বরতন্ত্রীতে স্পর্শ লাগে না বা স্বরতন্ত্রী কেঁপে ওঠে না তাদেরকে অঘোষ ধ্বনি (Unvoiced sounds) বলে। বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণকে অঘোষ ধ্বনি বা অঘোষ বর্ণ বলে। উদাহরণ : ক, খ, চ, ছ, ট, ঠ, ত, থ, প, ফ।

বিভিন্ন প্রকার ধ্বনিকে ছকের সাহায্যে দেখাও:

 অঘোষ ধ্বনিঘোষধ্বনি
উচ্চারণ স্থানঅল্পপ্রাণমহাপ্রাণঅল্পপ্রাণমহাপ্রাণনাসিক্য
কণ্ঠ
তালু
মূর্ধা
দন্ত
ওষ্ঠ্য

অন্তঃস্থ বর্ণের পরিচয়: য, র, ল, ব স্পর্শ বর্ণ ও উষ্মবর্ণের অন্তে বা মধ্যে বসে বলে এগুলোকে অন্তঃস্থ বর্ণ বলে। এর মধ্যে য, ও ব কে অর্ধঃস্বর (Semi-vowel) ও র ও ল কে তরল স্বর (liquids) বলে। এ প্রসঙ্গে উষ্মবর্ণ ও স্পর্শবর্ণের পরিচয় জানা প্রয়োজন। শ, ষ, স, হ- এগুলো উষ্মবর্ণ। উষ্ম শব্দের অর্থ নিঃশ্বাস। যত সময় শ্বাস থাকে তত সময় এগুলোর উচ্চারণ দীর্ঘ করা যায়। তবে নাসিক্য বর্ণ ছাড়া অন্য স্পর্শবর্ণগুলোকে দীর্ঘ উচ্চারিত করা যায় না। উষ্মবর্ণের বাইরে সব ব্যঞ্জনই স্পর্শ বর্ণ। অর্থাৎ এগুলো উচ্চারিত হবার সময় বাগযন্ত্রের কোথাও না কোথায় স্পর্শ করে।

উষ্ম ধ্বনির পরিচয়: ঊর্ধ্বস্থ ও নিম্নস্থ স্বরতন্ত্রী দুটো পরস্পর কাছাকাছি আসার ফলে যদি শ্বাসবায়ুর যাতায়াতে আংশিক বাধার সৃষ্টি হয় এবং সেই ঠেলে যাতায়াত করার ফলে একটি ঘর্ষণ ধ্বনির সৃষ্টি হয় তবে সেভাবে উচ্চারিত ধ্বনিকে উষ্মধ্বনি (Fricative) বলে। উষ্মধ্বনিকে শিসধ্বনিও বলা হয়ে থাকে। কারণ, এই বর্ণগুলো উচ্চারণ করতে শিসের মত ধ্বনি তৈরি হয়। উদাহরণ: স,শ।

ঘৃষ্টধ্বনির (Affricative) সংজ্ঞা: যদি কোন ধ্বনি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ুর গতিপথে প্রথমে স্পর্শধ্বনির মত পূর্ণ বাধার সৃষ্টি হয় এবং ক্ষণকাল পরেই সেই বাধা কমে উষ্মধ্বনির মত আংশিক বাধার পরিণত হয় তবে সেই ধ্বনিকে ঘৃষ্টধ্বনি বলে। মূলত সৃষ্টিধ্বনি স্পর্শধ্বনি ও উষ্মধ্বনির সংমিশ্রণ। যেমন- চ, ছ, জ, ঝ।

উচ্চারণ স্থান অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণীবিভাগ-

১. জিহ্বামূলীয় ধ্বনি : উচ্চারণ স্থান : কোমল তালু যেমন- ক, খ, গ, ঘ, ঙ, ং
২. কণ্ঠ্য : যেমন, হ।
৩. তালব্য বা অগ্র তালুজাত : চ, ছ, জ, ঝ, শ।
উচ্চারণ স্থান : অগ্র তালু। উচ্চারক : জিভের পাতা।
৪. দন্তমূলীয় মূর্ধন্য : ট, ঠ, ড, ঢ়, ড়।
উচ্চারণ স্থান : দন্তমূল (পন্ডাৎ)। উচ্চারক : জিভের ডগা।
৫. দন্তমূলীয় : র, ল, স, জ, ন।
উচ্চারণ স্থান : জিভের অগ্রভাগ।
৬. দন্ত : ত, থ, দ, ধ।
উচ্চারণের স্থান : উপরের দাঁত। উচ্চারক : জিভের অগ্রভাগ।
৭. ওষ্ঠ্য : প, ফ, ব, ভ, ম।
উচ্চারণের স্থান : উপরের ঠোঁট। উচ্চারক : নিচের ঠোঁট।

উচ্চারণরীতি অনুসারে ব্যঞ্জনবর্ণের শ্রেণীবিভাগ-

১. স্পৃষ্ট : অল্পপ্রাণ : ক, গ, ট, ভ, ত, দ, প, ব।
মহাপ্রাণ : খ, ঘ, ঠ, ঢ, থ, ধ, ফ, ভ।
২. ঘৃষ্ট : অল্পপ্রাণ : চ, জ, মহাপ্রাণ : ছ, ঝ।
৩. নাসিক্য : ঙ, ন, ম।
৪. কম্পনজাত : র।
৫. তাড়নজাত : ড়, ঢ়।
৬. উষ্ম : স, শ, জ, ফ, ভ, হ।
৭. অর্ধঃস্বর : য়।

ধ্বনি পরিবর্তন

অপিনিহিতির (Epenthesis) সংজ্ঞা: শব্দের মধ্যে অবস্থিত ই বা উ (ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত) ব্যঞ্জনের আগে এসে উচ্চারিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে অপিনিহিতি বলে। করিয়া > কইরা, বলিয়া > বইলা ইত্যাদি।

স্বরসঙ্গতির (Vowel Harmony): শব্দের মধ্যে কাছাকাছি অবস্থিত দুটি পৃথক স্বরধ্বনির মধ্যে যদি একটি অন্যটির প্রভাবে বা পরস্পরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে একই রকম ধ্বনিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে স্বরসঙ্গতি বলে। বিলাতি > বিলেতি, সুপারি, দেশি > দিশি।

অভিশ্রুতি (Umlaut)র সংজ্ঞা: অভিশ্রুতি অপিনিহিতির পরের ধাপ। অপিনিহিতির ফলে ব্যঞ্জনের সরে আসা ই বা উ পাশাপাশি স্বরধ্বনিকে প্রভাবিত করে এবং নিজেও তার সঙ্গে মিশে পরিবর্তিত হয়ে যায়- এই প্রক্রিয়াই হল অভিশ্রুতি। অপিনিহিতি – করিয়া > কইরা , অভিশ্রুতি – কইরা > করে।

শব্দ

শব্দের (Words) ধারণা: ভাষার অন্যতম প্রধান উপাদান। শব্দ দিয়েই বাক্য গঠিত হয়। আর বাক্যই ভাষার সম্পূর্ণ অর্থবোধক উপাদান। একটি ভাষার শব্দভান্ডার নানাভাবে তৈরি হয়। ব্যাকরণে শব্দ গঠনের নানা প্রক্রিয়া রয়েছে। অন্যদিকে ভাষার শব্দ নানাভাবে সংগৃহীত হয়। এই প্রক্রিয়া সময়ের সাথে, ভাষাভাষীর মানুষের চলমান জীবনের অংশবিশেষ। এর সাথে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণ জড়িত। বাংলাদেশ নামক এই জনপদের জনগোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকে নানা জাতির সংস্পর্শে এসেছে। এদেশ দখল করেছে ভিন দেশীরা, ধর্ম প্রচার করতে এসেছেন কেউ, কেউ আবার এসেছেন ব্যবসায়-বাণিজ্যের কারণে। এভাবে আমাদের ভাষায় সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, ফরাসী, চীন, তুর্কি শব্দ চলে এসেছে। এসব শব্দ এমনভাবে আমাদের ভাষায় মিশে গেছে যে, আমরা তাদেরকে বিদেশী ভাষা বলে সনাক্ত করতে পারি না সবসময়। চাইও না অনেক সময়।

বাংলা ভাষার শব্দ গঠন প্রক্রিয়া সন্ধি, সমাস, প্রত্যয়, উপসর্গ, অনুসর্গ ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। এখন সন্ধি, সমাস, প্রত্যয়, উপসর্গ, অনুসর্গ সম্পর্কে সার্বিক ধারণা দেয়া হচ্ছে।

সন্ধির ধারণা: পাশাপাশি দুটি বর্ণ সংস্পর্শে এলে তারা উভয়ে কখনো মিলিত হয়ে এক বর্ণে পরিণত হয়, কখনো তাদের একটির রূপান্তর হয়, কখনো একটি লোপ পায় অথবা উভয়ের রূপান্তর হয়-এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে-এইভাবে বর্ণ দুটির মিলনকে সন্ধি (Euphonic combination) বলে। সহজ কথায় পাশাপাশি দুটি বর্ণ বা ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে।

বাংলা সন্ধি দু’প্রকার- ১) স্বরসন্ধি, ২) ব্যঞ্জনসন্ধি। এছাড়া বিসর্গ সন্ধিকে আলাদাভাবে বিভক্ত করা হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিসর্গ সন্ধিকে ব্যঞ্জসন্ধির অন্তর্ভুক্ত মনে করেন।

স্বরসন্ধির ধারণা: দুটো স্বরবর্ণের মধ্যে সন্ধি সংগঠিত হলে তাকে স্বরসন্ধি বলে। স্বরসন্ধি দু’ধরনের হয়। স্বরের বহিঃসন্ধি ও স্বরের অন্তঃসন্ধি। বহিঃসন্ধি ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা শব্দ মিলিত হয়। অন্তঃসন্ধির ক্ষেত্রে শব্দ ভেঙে সন্ধি তৈরি হয়।

বহিঃসন্ধির কতিপয় উদাহরণ-

১. বিদ্যা + আলয় – বিদ্যালয়। আ + আ = আ ; শশ + অঙ্ক – শশাঙ্ক। অ + অ = আ
২. যতি + ইন্দ্র – যতীন্দ্র। ই + ই = ই ; পৃথিবী + ঈশ্বর – পৃথবীশ্বর। ই + ঈ = ঈ
৩. যথা + উচিত – যথোচিত। আ + উ = ও ; চল + ঊর্মি – চলোর্মি। অ + ঊ = ও
৪. অতি + অন্ত – অত্যন্ত। ই + অ = য ; অতি + আচার – অত্যাচার। ই + আ = যা

১। অ-কার কিংবা আ-কারের পর অ-কার কিংবা আ-কার থাকলে উভয়ে মিলে আ-কার হয়, আ-কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত বর্ণে যুক্ত হয়; যথা-

স্বরসন্ধি

অ + অ = আপ্রাণ + অন্ত = প্রাণান্ত
অ + আ = আজল + আশয় = জলাশয়
আ + অ = আমহা + অর্ঘ = মহার্ঘ
আ + আ = আবিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়

২। ই-কার কিংবা ঈ-কারের পর ই-কার কিংবা ঈ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঈ-কার হয়, ঈ-কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয়; যথা-

ই + ই = ঈরবি + ইন্দ্র = রবীন্দ্র
ই + ঈ = ঈপরি + ঈক্ষা = পরীক্ষা
ঈ + ই = ঈরথী + ইন্দ্র = রথীন্দ্র
ঈ + ঈ = ঈসতী + ঈশ = সতীশ

৩। উ-কার কিয়বা ঊ কারের পর উ-কার কিংবা ঊ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঊ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঊ-কার হয়, ঊ-কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয়; যথা-

ঊ + উ = ঊকটূ + উক্তি = কটূক্তি

৪। অ-কার কিংবা আ-কারের পর ই-কার কিংবা ঈ-কার থাকলে উভয়ে মিলে এ-কার হয়, এ-কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয়; যথা-

অ + ই + এদেব + ইন্দ্র = দেবেন্দ্র
অ + ঈ = এগণ + ঈশ = গণেশ
আ + ই = এযথা + ইচ্ছা = যথেচ্ছা
আ + ঈ = এউমা + ঈশ = উমেশ

৫। অ-কার কিংবা আ-কারের পর উ-কার কিংবা ঊ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ও-কার হয়, ও-কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয়; যথা-

অ + ঊ = ওনব + ঊঢ়া = নবোঢ়া (নব বিবাহিতা)
আ + উ = ওমহা + উৎসব = মহোৎসব

৬। অ-কার কিংবা আ-কারের পর ঋ-কার থাকলে উভয়ে মিলে র্অ হয়, র্অ পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয় যথা-

অ + ঋ = র্অউত্তম + ঋণ = উত্তমর্ণ
আ + ঋ = র্অমহা + ঋষি = মহর্ষি

ব্যতিক্রম: শীত + ঋত = শীতার্ত, ক্ষুধা + ঋত = ক্ষুধার্ত।

৭। অ-কার কিংবা আ-কারের পর এ-কার কিংবা ঐ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঐ-কার হয়, ঐ-কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয়; যথা-

অ + এ = ঐজন + এক = জনৈক
অ + ঐ = ঐমত + ঐক্য = মতৈক্য
আ + এ = ঐতথা + এব = তথৈব
আ + ঐ = ঐমহা + ঐশ্বর্য = মহৈশ্বর্য

৮। অ-কার কিংবা আ-কারের পর ও-কার কিংবা ঔ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঔ-কার হয়, ঔ-কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয়; যথা-

অ + ও = ঔজল + ওকা = জলৌকা
অ + ঔ = ঔউত্তম + ঔষধ = উত্তমৌষধ
আ + ঔ = ঔমহা + ঔষধ = মহৌষধ

৯। ই, ঈ ভিন্ন স্বরবর্ণ পরে থাকলে ই, ঈ স্থানে য্ হয়, য য-ফলারূপে পূর্ব বর্ণে এবং পরের স্বর য-কারের সাথে সংযুক্ত হয়; যথা-

ই + অ = য্ + অ (্য)যদি + অপি = যদ্যপি
ই + আ = য্ + আ (্যা)অতি + আচার = অত্যাচার
ই + উ = য্ + উ (্য ু)প্রতি + উক্তি = প্রত্যুক্তি
ই + ঊ = য্ + ঊ (্য ূ)প্রতি + ঊষ = প্রত্যুষ
ঈ + আ = য্ + আ (্য া)মসী + আধার = মস্যাধার (দোয়াত)

১০। উ ভিন্ন স্বরবর্ণ পরে থাকলে, উ, ঊ স্থানে ব্ হয় এবং পরের স্বর ব-কারে যুক্ত হয়; যথা-

 সু + অল্প = স্বল্প
উ + অ = ব্ + অ           সু + অচ্ছ = স্বচ্ছ
উ + আ = ব্ + আসু + আগত = স্বাগত
উ + ই = ব্ + ই  অনু + ইত = অন্বিত
উ + এ = ব্ + এঅনু + এষণ = অন্বেষণ
 অনু + আদি = অন্বাদি

১১। স্বরবর্ণ পরে থাকলে এ স্থানে অয়, ঐ স্থানে আয়, ও স্থানে অব এবং ঔ স্থানে আব হয়, পরবর্তী স্বরবর্ণ অ বা আ-এর সাথে পূর্ববর্তী য় বা ব যুক্ত হয়; যথা-

এ + অ = অয় + অশে + অন = শয়ন
ঐ + অ = আয় +অগৈ + অক = গায়ক
ও + অ = অব + অপো + অন = পবন
ঔ + অ + আব + অপৌ + অক = পাবক

নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি: কয়েকটি স্থলে সন্ধি কোন নিয়ম অনুসারে হয় না, এদের নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি বলে। যথা-

বিম্ব + ওষ্ঠ = বিম্বোষ্ঠস্ব + ঈরিণী = স্বৈরিণী
গো + অক্ষ = গবাক্ষসার + অঙ্গ = সারঙ্গ
কুল + অটা = কুলটাপ্র + উঢ় = প্রৌঢ়
মার্ত + অণ্ড = মার্তণ্ড 

ব্যঞ্জনসন্ধি

ব্যঞ্জনসন্ধি শ্রেণিবিভাগ: ব্যঞ্জনসন্ধি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। যেমন- ক. ব্যঞ্জনবর্ণ + স্বরবর্ণ , খ. স্বরবর্ণ + ব্যঞ্জনবর্ণ , গ. ব্যঞ্জনবর্ণ + ব্যঞ্জনবর্ণ । নিম্নে তিন প্রকারের ব্যঞ্জনসন্ধিই আলোচনা করা হচ্ছে-

১। চ কিংবা ছ পরে থাকলে পূর্ববর্তী ত্ ও দ্ স্থানে চ হয়; যথা-

ত্ + চ = চ্চচলৎ + চিত্র = চলচ্চিত্র
ত্ + ছ = চ্ছউৎ + ছেদ = উচ্ছেদ
দ্ + চ = চ্চবিপদ + চিন্তা = বিপচ্চিন্তা

২। জ কিংবা ঝ পরে থাকলে ত্ ও দ্ স্থানে জ হয়; যথা-

ত্ + জ = জ্জসৎ + জন = সজ্জন
দ্ + জ = জ্জবিপদ্ + জনক = বিপজ্জনক
ত্ + ঝ = জঝকুৎ + ঝটিকা = কুজ্ঝটিকা

৩। ড পরে থাকলে (পূর্ব পদের অন্তস্থিত) ত্ স্থানে ড্ হয়; যথা-

ত্ + ড = ড্ডউৎ + ডীন = উড্ডীন

৪। ল পরে থাকলে পূর্বস্থিত ত্ ও দ্ স্থানে ল হয়; যথা-

ত্ + ল = ল্লউৎ + লাস = উল্লাস
 উ ৎ + লেখ = উল্লেখ
দ্ + ল = ল্লসম্পদ + লাভ = সম্পল্লাভ

৫। শ পরে থাকলে ত্ ও দ্ স্থানে চ্ এবং শ্ স্থানে ছ হয়; যথা-

উৎ + শৃঙ্খল = উচ্ছৃঙ্খলতদ + শ্রবণ = তচ্ছ্রবণ

৬। পদের অন্তস্থিত ত্ কিংবা দ্-এর পর হ থাকলে ত্ ও দ্ স্থানে দ এবং হ্ স্থানে ধ হয়; যথা-

ত্ + হ = দ্ধউৎ + হার = উদ্ধার
দ্ + হ = দ্ধতদ্ + হিত = তদ্ধিত

৭। স্বরবর্ণ, বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ বর্ণ কিংবা য, র, ল, ব পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত বর্ণের প্রথম বর্ণ স্থানে সেই বর্গের তৃতীয় বর্ণ হয় (অর্থাৎ ক্ স্থানে গ্, চ্ স্থানে জ্, ট্, স্থানে ড্, ত্, স্থানে দ্ এবং প্, স্থানে ব হয়); যথা-

দিক্ + অন্ত= দিগন্তদিক্ + গজ = দিগ্গজ
ষ্ট + যন্ত্র = ষড়যন্ত্রঅপ + জ = অব্জ
বাক্ + জাল = বাগজাল 

৮। স্বরবর্ণ অথবা গ, ঘ, দ, ধ, ব, ভ, য, র, ল, ব, হ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ত্ স্থানে দ্ হয়; যথা-

সৎ + আশয় = সদাশয়উৎ + যোগ = উদ্যোগ
তৎ + অন্ত = তদন্তউৎ + ভিদ = উদ্ভিদ
জগৎ + বন্ধু = জগদ্বন্ধু   

৯। ন কিংবা ম পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত বর্গের প্রথম বর্ণ স্থানে সেই বর্গের পঞ্চম বর্ণ হয়; যথা-

দিক্ + নির্ণয় = দিঙ্নির্ণয়বাক্ + ময় = বাঙ্ময়
ষট + মাস = ষন্মাসজগৎ + নাথ = জগন্নাথ

১০। স্বরবর্ণের পরে ‘ছ’ থাকলে ছ্ স্থানে চ্ছ স্থানে হয়; যথা-

পরি + ছেদ = পরিচ্ছেদপরি + ছন্ন = পরিচ্ছন্ন
তরু + ছায়া = তরুচ্ছায়াবি + ছেদ = বিচ্ছেদ

বিসর্গ সন্ধি

বিসর্গ একটি ব্যঞ্জনবর্ণ। সংস্কৃত শব্দের পদান্তিকর্ অথবা স-বর্ণের এটি একটি সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা দুই ভাগে বিভক্ত। স্-জাত ওর্ -জাত।

১। চ কিংবা ছ পরে থাকলে বিসর্গ স্থানে শ্, ট কিংবা ঠ পরে থাকলে বিসর্গ স্থানে য এবং ত কিংবা থ পরে থাকলে বিসর্গ স্থানে স্ হয়; যথা-

নিঃ + চয় = নিশ্চয়অনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার
দুঃ +চরিত্র = দুশ্চরিত্রনিঃ + তার = নিস্তার
দুঃ + ছেদ্য = দুশ্ছেদ্যমনঃ + তাপ = মনস্তাপ
দুঃ + যোগ = দুর্যোগ 

২। ক, খ ও প, ফ পরে থাকলে কখনও অ-কার কিংবা আ-কারের পরস্থিত বিসর্গ স্থানে স এবং অ, আ ভিন্ন স্বরবর্ণের পরস্থিত বিসর্গ স্থানে ষ হয়; যথা-

পুর ঃ + কার = পুরষ্কারনিঃ + কর + নিষ্কও
নম ঃ+ কার = নমস্কারনিঃ + পাপ = নিষ্পাপ
ভাঃ + কর = ভাস্করনিঃ + ফল = নিষ্ফল

কিন্তু কতকগুলো স্থলে সন্ধি হয় না। যেমন- অতঃপর, অন্তঃকরণ, শিরঃপীড়া ইত্যাদি।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: র্ এবং স্ হতেই বিসর্গের উৎপত্তি হয়। পদের অন্তস্থিতর্ স্থানে যে বিসর্গ হয় তাকে র-জাত বিসর্গ বলে। যথা-

অর্ন্ত – অন্তঃর্নি – নিঃপ্রার্ত – প্রাতঃ
পুর্ন – পুনঃচর্তু – চতুঃর্দু – দুঃ

পদের অন্তঃস্থিত স্ স্থানে যে বিসর্গ হয় তাকে স-জাত বিসর্গ বলে; যথা-

অধস্ – অধঃঊক্ষস্ – বক্ বয়স্ – বয়ঃ
শিরস্ – শিরঃমনস্ – মনঃবহিস্ – বহিঃ
যশস্ – যশঃআবিশ্ – আবিঃ 

৩। বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বর্ণ কিংবা য্র্ ল্ ব্ হ্ পরে থাকিলে অ-কার ও আ-কারের পরস্থিত স-জাত বিসর্গ উভয়ে মিলে ও-কার হয় এবং ও-কার পূর্ববর্ণে মিলিত হয়। যথা-

অধঃ + মুখ = অধোমুখশির: + ধার্য = শিরোধার্য
মনঃ+ যোগ = মনোযোগসর: + বর = সরোবর

৪। অ-কার ভিন্ন স্বরবর্ণ পরে থাকলে অ-কারের পরস্থিত স-জাত বিসর্গের লোপ হয়, একবার লোপ হলে আর দ্বিতীয়বার সন্ধি হয় না; যেমন-

অতঃ + এব = অতএব  ঐশঃ + ইচ্ছা = যশ-ইচ্ছা
অহঃ + রহ = অহরহ 

৫। স্বরবর্ণ বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বর্ণ অথবা য্,র্ , ল্, ব্, হ্ পরে থাকলে অ-কারের পরস্থিত র-জাত বিসর্গ স্থানে হয় না; যেমন-

অন্তঃ+ আত্মা = অন্তরাত্মাপ্রাতঃ + ভ্রমণ = প্রাতভ্রমণ
পুনঃ + বসতি = পুনর্বসতি 

৬। স্বরবর্ণ, বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বর্ণ কিংবা য্,র্ , ল্, ব্, হ্ পরে থাকলে অ-কার ভিন্ন স্বরবর্ণের পরস্থিত বিসর্গ স্থানের্ হয়। যথা-

নিঃ + আকার = নিরাকার নিঃ + গত = নির্গত
দুঃ + আচার = দুরাচার 

৭। হ্রস্ব স্বরের পরবর্তী বিসর্গের পরের্ থাকলে বিসর্গেরর্ স্থানে যের্ হয় তার লোপ হয়, পরবর্তী হ্রস্ব দীর্ঘ হয়। যথা-

নিঃ + রব = নীরবনিঃ + রস = নীরস
চক্ষঃু + রোগ = চক্ষুরোগ 

নিপাতনে সন্ধি: নিম্নলিখিত সন্ধিগুলো কোন নিয়ম অনুসারে হয় না বলে এদেরকে নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি বলে। যথা-

বন + পতি = বনস্পতিগো + পদ = গোষ্পদ
মনস্ + ঈষা = মনীষাআ + চর্য = আশ্চর্য
আ + পদ = আপদপ্রায় + চিত্ত = প্রায়শ্চিত্ত
তৎ + কর = তস্কর 

খাঁটি বাংলা সন্ধি:

হাত + দেখা = হাতদেখাচার + শো = চারশো বা চাশ্শোপাঁচ + সের = পাঁচসের বা পাস্সের


দয়া করে পোস্টটি শেয়ার করুন...

© BengaliGrammar.Com
Maintenance by BengaliGrammar.Com