মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫১ পূর্বাহ্ন
ভাষার সংজ্ঞা: ভাষা মানব জাতির অন্যতম উপাদান। মানুষ তার বাকধ্বনির সাহায্যে উচ্চারিত সংকেত ব্যবহার করে পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময় করে। ভাববিনিময়ের এই মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষা মানুষ এমন সহজাতভাবে ব্যবহার করে যে, এর সম্পর্কে সে খুব বেশি ভাবে না।
প্রাণিজগত ভাষা ব্যবহার: ধারণা করা হয় মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা নেই। মানুষ ভাষার আধুনিক রূপ আবিষ্কার করার পূর্বে সাংকেতিক ভাষা বা ইশারা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োজন মেটাত। প্রাণীজগতও অনুরূপভাবে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন বিশেষ ভাষা ব্যবহার করে থাকতে পারে। এই ধারণার পক্ষেও অনেকে যুক্তি তুলে ধরেছেন। মারিও পাই এর ধারণা- Some Scientists claim that certain animal species communicate by non linguistic devices; that bees, for example, convey significant messages to one another by dancing in their hives, or that ants use their antennae in a significant way. (Mario Pie : 10)
মাতৃভাষা (Mother Tongue) কাকে বলে? মাতৃভাষা হলো মায়ের ভাষা। Tongue শব্দের অর্থ জিহ্বা। কাজেই মাতৃভাষা হলো জিহ্বা ভাষা। শিশুকাল থেকে যে ভাষা শুনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে মানুষ তা-ই তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষার সাথে ব্যক্তির অভ্যাস, বাকভঙ্গি, স্মৃতি, জাতীয়তা, আঞ্চলিকতা এসব জড়িত। একটি রাষ্ট্র বা এলাকার জনগোষ্ঠী শিশুকাল থেকে শুনে শুনে বাকযন্ত্রের সাহায্যে যে ভাষা রপ্ত করে ফেলে তা-ই মাতৃভাষা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় বাংলা ভাষা চালু আছে, অনেক ভিন্ন জাতির লোক বাংলা ভাষা ব্যবহার করে তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। বাংলা ভাষা বাঙালির গৌরবের, ঐতিহ্যের বস্তু। ভাষার জন্য এই জাতির সন্তানেরা সংগ্রাম করে শহীদ হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতির অধিকার মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতিনিধি হলো মাতৃভাষা। উচ্চারণ প্রবণতা, ভৌগলিক অবস্থান ও রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ে এর সাথে জড়িত।
বাংল ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে ধারণা: বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন ভাষা। পৃথিবীতে প্রচলিত চার হাজারের অধিক ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান ষষ্ঠ। এই স্থান জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিবেচ্য হলেও, বাংলা ভাষার সংগঠন, বৈশিষ্ট্য, লিপি উচ্চারণ, রচিত সাহিত্য এসব বিবেচনায় বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। এই ভাষার জন্য এদেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
পৃথিবীর যাবতীয় ভাষাকে তাদের বৈশিষ্ট্য ও ব্যুৎপত্তির দিক লক্ষ রেখে অনেকগুলো গ্রুপে ভাগ করা হয়। এদেরকে ভাষাগোষ্ঠী বলে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্দো-ইউরোপীয় বা ইন্দো জার্মানিক, সেমীয়-হামীয়, বান্টু, ফিন্নোউগ্রীয় বা উরালীয়, তুর্ক-মোঙ্গল-মাঞ্চু, ককেশীয়, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, ভোট-চীনীয়, প্রাচীন-এশীয়, এস্কিমো, আমেরিকান, আদিম, কোরীয়-জাপানি ইত্যাদি। বাংলা ভাষা সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই কারণে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সাহিত্য এই ভাষায় রচিত। সংস্কৃত, গ্রীক, লাতিন এই ভাষা বংশের মধ্যে পড়ে। এই বংশ থেকেই আধুনিক সমৃৃদ্ধ ভাষা ইংরেজি, জার্মান, ফরাসী, ইটালীয়, রুশীয়, বাংলা, হিন্দি ইত্যাদি উৎপত্তি লাভ করেছে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও নানা বিষয়ে, বিস্ময়কর সব জ্ঞান এসব ভাষায় রচিত এবং তা পৃথিবীর অনান্য ভাষাভাষীদের প্রভাবিত করেছে। ইন্দো-ইউরোপীয় বা মূল আর্য থেকে ১০টি প্রাচীন শাখার জন্ম। এরা হলো- ১. ইন্দো-ইরানীয়, ২. বালেতাস্লাবিক ৩. আলবানীয় ৪. আর্মেনীয় ৫. গ্রীক, ৬. ইটালিক, ৭. জার্মানিক বা টিউটোনিক, ৮. কেল্তিক ৯. তোখারীয়, ১০. হিত্তীয়। ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের সমৃদ্ধ প্রাচীন ভাষা হলো- গ্রীক, ইন্দো-ইরানীয় শাখার আবেস্তীয় ও সংস্কৃত, ইতালিক শাখার লাতিন ও জার্মানিক শাখার গথিক ভাষা। অনেকের ধারণা এই বংশের প্রাচীন ভাষা বৈদিক সংস্কৃতে রচিত ঋগে¦দ-সংহিতা (খ্রী. পূর্ব ১২০০) সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একে শতম ও কেন্তুম এই দুই গ্রট্টপে ভাগ করা হয়। শতম গ্রট্টপের অন্যতম ধারা ইন্দো-ইরানীয়। মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার যে শাখাটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারতবর্ষ ও ইরানে প্রবেশ করে সেই শাখাই হল ইন্দো-ইরানীয় শাখা।
ইন্দো-ইরানীয় শাখার যে উপশাখা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তাকেই বলা হয় ভারতীয় আর্য। ভারতীয় আর্যকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়- ১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য (আ. ১৫০০ খ্রী. পূর্ব-৬০০ খ্রী. পূর্ব) ২. মধ্য ভারতীয় আর্য (আ. ৬০০-খ্রী. পূর্ব-৯০০ খ্রী.) ৩. নব্যভারতীয় আর্য (আ. ৯০০-খ্রী.-বর্তমান)। অনুবাদন করা হয় বাংলা ভাষা নব্যভারতীয় আর্য শাখা থেকে বিকাশ লাভ করেছে। অবশ্য ৯০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষার জন্ম এই অনুমান করেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অবশ্য মনে করেন, বাংলা ভাষা ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জন্মলাভ করেছে।
অনেকের ধারণা বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। সংস্কৃত এ অঞ্চলের অন্যতম মূলভাষা সন্দেহ নেই। সংস্কৃত শব্দের বড় অংশ বাংলার শব্দ ভান্ডারে মিশে আছে। তবে, সংস্কৃত ভাষা মূলত মৃত ভাষা ছিল, অর্থাৎ কৃত্রিম ভাষা ছিল। সে সময় মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা থেকে সংস্কার করে দরবারী ভাষা হিসেবে সংস্কৃত তৈরি করা হয়। মানুষের মুখের ভাষা ছিল প্রাকৃত। ভারতের বিভিন্ন এলাকা ভেদে পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রাচ্য অঞ্চলে ছিল বাংলা, উড়িয়া, অসমিয়া, মৈথিলী ইত্যাদি।
ড. সুনীতিকুমার এবং অন্যান্য ভাষাতাত্ত্বিকের ধারণা প্রাচ্য শাখা থেকে মাগধী প্রাকৃত হয়ে মাগধী অপভ্রংশ হয়ে বাংলা ভাষার জন্ম। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে গোড়ীয় প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব।
ব্যাকরণের সংজ্ঞা: ব্যাকরণ হলো ভাষার ইতিহাস ও নিয়ম-কানুন সংক্রান্ত পুস্তক যেখানে সংশ্লিষ্ট ভাষার ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক দিকের সামগ্রিক আলোচনা থাকে। ভাষার উপাদান, উপাদানসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েও ব্যাকরণ আলোচনা করে। তবে ‘যে পুস্তক পাঠ করিলে’ জাতীয় সংজ্ঞা ব্যাকরণকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে না। মোট কথা ভাষার স্বরূপ, উপাদানাসমূহের সম্পর্ক ও ব্যবহারিক নিয়ম-রীতি যে পুস্তকে আলোচিত হয় তাকে ব্যাকরণ বলা চলে। বাংলা ভাষার সামগ্রিক নিয়ম-রীতির বিবরণ হলো বাংলা ব্যাকরণ। বাংলা ভাষার ইতিহাস, লিপি বর্ণের ইতিহাসও ব্যাকরণের অংশ। তবে ব্যাকরণ সাধারণত ভাষা সম্পর্কিত সনাতন বা ঐতিহ্যভিত্তিক রীতি-পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে। এই আলোচনা সব সময় বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। ভাষা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক যুক্তিযুক্ত ও প্রামাণিক আলোচনা হয় ভাষাতত্ত্ব (Linguistics) নামক শাস্ত্রে। ভাষাতাত্ত্বিকের ভাষার ব্যবহার, উপাদান, উচ্চারণ, উপাদানসমূহের সম্পর্ক নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা করেছেন- মোট কথা ভাষা সম্পর্কিত Traditional Studies এর পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক চর্চাকেই ভাষাতত্ত্ব বলে।
ভাষার রূপ কয় প্রকার? ভাষাকে দুটো পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়- (ক) লিখিত রূপ বা সাহিত্যিক ভাষা ও (খ) কথ্য ভাষা। ক. লিখিত ভাষা একটু প্রাচীনপন্থী। দীর্ঘদিন যাবৎ একটি ভাষায় রচিত সাহিত্য বা অন্যান্য আলোচনা এই ভাষায় রচিত হয়। একটি স্থির রীতি বা Style এখানে গ্রহণ করা হয়। শব্দ ব্যবহার, বাক্যগঠন এবং সৌন্দর্যময়তা (আলঙ্কারিক গুণ) এখানে বিশেষভাবে রক্ষা করা হয়। সমগ্র দেশের শিক্ষিত সমাজ এই ভাষায় লেখালেখি করেন। এই ভাষা জাতীয় ঐক্যেরও প্রতীক। মুদ্রিত বা প্রকাশিত গ্রন্থাদিতে এই ভাষা লক্ষ করা যায়। লিখিত ভাষার রূপকে (বাংলা ভাষায়) দুটি ভাগ করা হয়- ১) সাধু ভাষা ২) চলিত ভাষা।
সাধু ভাষার (Standard Literary Language) পরিচয়: বাংলা ভাষার প্রাচীন লিখিত রূপকে সাধু ভাষা বলা হয়। এখন এই ভাষার ব্যবহার লুপ্ত হয়ে গেছে বলা চলে। তবে ঐতিহ্য হিসেবে কেউ কেউ লিখে থাকেন এখনো, দু’একটি সংবাদপত্রও এই ভাষায় নিবন্ধ ছাপে। তবে বাংলা গদ্যের শুরু থেকে বিশ শতকের প্রথম দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত এই ভাষা ব্যাপক চালু ছিল। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম করেজে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে তৎকালীন পন্ডিতেরা মোটামুটি সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণকে অনুসরণ করে বাংলা গদ্য লিখতে শুরু করেন। বেশ গুরুগম্ভীর এই ভাষাই ছিল সাধু ভাষা। তবে, সাহিত্য রচনার হিসেব বাদ দিলে ষোল-সতের শতকে এদেশের দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, সংবাদপত্রে সাধু ভাষার ভিন্নরূপ চালু ছিল। ১৮০০ সালের আগে বা ১৮২০-৩০ এর আগে বাংলা ভাষায় রচিত সব সাহিত্য পদ্যে রচিত হত। যুক্তি-তর্ক-বিজ্ঞান চর্চার অভাবেই গদ্য চর্চা না হবার কারণ হিসেবে দেখানো হয়। তবে মধ্যযুগে রচিত অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ বা পদ্যে রচিত গ্রন্থের ভাষা থেকে গদ্য ভাষা রচনার সূত্রপাত না করে ফোর্ট উইলিয়ামের পন্ডিতেরা কেন সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করতে গেলেন তা বোঝা মুশকিল। শিক্ষত ব্রাহ্মণ শ্রেণীর চাপ বা আভিজাত্যই এর নেপথ্য কারণ হতে পারে। যাই হোক, সংস্কৃত ভাষার সার্বিক অনুসরণে ভাবগম্ভীর-নিয়ম-শৃঙ্খলাযুক্ত কৃত্রিম ভাষাকেই সাধু ভাষা বলা হয়। এই ভাষার গঠন মোটামুটি স্থির এবং এখানে ব্যাকরণের নিয়ম-শৃঙ্খলা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাব ও ব্যক্তিস্বাধীনতা এখানে নেই বলে এই ভাষাকে মোটামুটি প্রামাণিক বলা চলে।
তবে সাধু ভাষার কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে। বিদ্যাচরণ তর্কলঙ্কার থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ প্রাথমিক পর্যায়ে সাধু ভাষার চর্চা করেন। পরবর্তী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সাধু ভাষাকে নানা মাত্রায় বিকশিত করেন। মুখের ভাষা বা চলিত ভাষা ততদিনে সামান্য হলেও লিখিত রূপে সংযুক্ত হতে থাকে। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার মাধ্যমে চলিত ভাষা লেখা শুরু করেন। তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ যোগ দেন এই আন্দোলনে। এইভাবে সাধু ভাষার শব্দ, পদ ও বাক্যগঠনের পরিবর্তন হয়। ‘সবুজপত্রে’র পরে, সাধু ভাষা লেখা চলতে থাকে, তবে চলিত ভাষা ধীরে ধীরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।
চলিত ভাষার (Colloquil language) পরিচয়: মুখের ভাষাকে লিখিত ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে চলিত ভাষার প্রচলন হয়। মুখের ভাষা অঞ্চলভেদে পরিবর্তন হয়। সুতরাং সবার মুখের ভাষাই চলিত ভাষা নয়। শিক্ষিত ও শিষ্টজনের মুখের ভাষা লিখিত রূপে ব্যবহৃত হয়-সেটাই শিষ্ট চলিত ভাষা। নিদিষ্ট ভাষিক অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট এলাকার মৌখিক ভাষাকে মান্য চলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে বর্তমানে চলিত ভাষা ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথের হাতে যে ভাষার উদ্ভব হয় তার বিকাশ শুরু হয় পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য লেখকের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা চলিত বাংলা ভাষায় হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমস্ত কর্মকাণ্ডে, রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র ও সাহিত্য চলিত ভাষার প্রয়োগ একগুচ্ছ। চলিত ভাষা দেশের ঐক্য ও সংগতির প্রকাশক। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রকমের আঞ্চলিক বা উপভাষা রয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট এলাকার বাইরের মানুষের বোধগম্য নয়। তবে, সবার সাথে কথা বলার সময় বা লেখার সময় তারা শিষ্ট চলিত ভাষায় লেখে বা কথা বলে। সাধু ভাষার গঠনের নানামাত্রিক পরিবর্তন হয় চলিত ভাষায়। মুখের ভাষার গুরুত্ব দেয়া হয় বলে মূল ভাষার অনেক শব্দের সহজ ও সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয় এ ভাষায়। সংস্কৃত শব্দ, ক্রিয়াপদ, সর্বনাম পদ, সমাসবদ্ধ পদ চলিত ভাষায় সংক্ষিপ্ত আকারে ও পরিবর্তিত আকারে ব্যবহৃত হয়।
উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার (dialect) বৈশিষ্ট্য: একটি দেশের বা সম্প্রদায়ের জাতীয় ভাষার নানা বৈচিত্র্য থাকে। অঞ্চলভেদে ভৌগোলিক বা অন্যান্য কারণে মূল ভাষার কাঠামো, উচ্চারণের পরিবর্তন হয়; অঞ্চলভেদে এই পরিবর্তনসমূহকে বৈশিষ্ট্য হিসেবে সনাক্ত করা যায়। অর্থাৎ মূল ভাষার মধ্য থেকে, মূল ভাষার কাঠামো ঠিক রেখে, ভাষার অঞ্চলভিত্তিক নতুন ভাষা কাঠামোই উপভাষা। উপভাষার রূপতাত্ত্বিক ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও সনাক্ত করা হয়। উপভাষায় ভাষার ধ্বনিপ্রবণতা, উচ্চারণ প্রবণতা ও বিশেষ ভঙ্গি লক্ষ করা যায়। বাংলা ভাষার বেশ কয়েকটি উপভাষা রয়েছে। বঙ্গাল, রাঢ়ী, বরেন্দ্রী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সাধু ভাষার বৈশিষ্ট্য:
ক. এই ভাষার বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্য সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের। সংস্কৃত শব্দবহুল।
খ. ব্যাকরণের নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলে। অপরিবর্তনীয়।
গ. এই ভাষা মুখের ভাষার গুরুত্ব দেয় না, ফলে এই ভাষা কৃত্রিম। এই ভাষা গাম্ভীর্যপূর্ণ, আলঙ্কারিক।
ঘ. সমাসবদ্ধ পদের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়।
ঙ. তৎসমের ক্রিয়াপদ, সর্বনামপদ, অনুসর্গ, অব্যয়পদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়।
চ. দৈনন্দিন কাজে, নাটকে, সংবাদপত্রের, ভাষণে-বক্তৃতায় এই ভাষা ব্যবহৃত হতে পারে না।
ছ. এটিকে একসময় সর্বজনগ্রাহ্য লেখার ভাষা হিসেবে বিবেচিত করা হত।
সাধু ভাষার নমুনা: সাহিত্যের ব্যবহৃত সাধু ভাষার নমুনা আজকাল আর চোখে পড়ে না। প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে, কখনো রম্য রচনা হিসেবে, দলিল-দস্তাবেজে, অফিস-আদালতে সাধু ভাষার ব্যবহার এখনো লক্ষ কার যায়। তবে, ক্রমশ এই ব্যবহারও সংকুচিত হচ্ছে।
১. এই যুগে বাঙ্গালা দেশে পশ্চিম হইতে আগত আর্যজাতির সঙ্গে অনার্য কোল জাতির সংস্রব ঘটে। ফলে বাঙ্গলার আদিম অধিবাসী কোল জাতি আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি* ক্রমশঃ১ গ্রহণ করে। অন্যপক্ষে তাহাদের দ্বারা আর্য সংস্কৃতি অল্পাধিক পরিমাণে প্রভাবান্বিত হয়।
২. শরীর ও মনের যেরূপ নিকট সম্বন্ধ তাহাতে শরীরের উন্নতির প্রতি সর্বাগ্রে আগে লক্ষ্য রাখা উচিত। মনুষ্যের শরীরও কলের মতো। অধিক দিন শরীর না চলিলে ইহাতেও মরিচা ধরে এবং অধিক বলে অধিক খাটাইলে ইহারও কল বিগড়িয়া যায়, ঠিক সময়ে দম দিলে যেমন ঘড়ি অনেক দিন চলে সেইরূপ নিয়মিত শ্রমেও মনুষ্য শরীর অনেক দিন টিকে।
৩. মানব সমাজের যে দিকে ও যে স্তরেই দৃষ্টিপাত করি, সেই দিকে কেবল অধর্মের পূর্ণ প্রসার দেখিতে পাই, কেবল আপন সংসারটি বজায় রাখার জন্য, পেট পুরাইবার জন্য লোকে দিনরাত অধর্ম করিয়া বেড়াইতেছে। মিথ্যা কথা বলিতেছে চুরি, জুয়াচুরি ডাকাতি করিতেছে। লাঠালাঠি খুনাখুনি রক্তারক্তি করিতেছে। আপাত মধুর ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির স্রোতে গা ভাসাইয়া দিতেছে।
চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ: ক. এই ভাষায় সংস্কৃতের তৎসম শব্দ ব্যবহৃত হয়। তবে ক্রিয়াপদ, সর্বনাম ও অব্যয়পদ সংক্ষিপ্তরূপে ব্যবহৃত হয়। খ. তৎসম ও তদ্ভবের সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ ব্যবহৃত হয়। গ. এই ভাষা মূলত মুখের ভাষার মার্জিত রূপ। ঘ. এই ভাষা পরিবর্তনশীল। এই ভাষা নতুন নতুন ব্যবহারিক পরিবর্তনকে সহজে গ্রহণ করে। ঙ. চলিত ভাষা বর্তমানে সাহিত্য, চিঠিপত্রসহ যাবতীয় মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। চ. এই ভাষা অকৃত্রিম, স্বাচ্ছন্দ, সাবলীল। ছ. চলিত ভাষার তদ্ভব, অর্ধ-তৎসম, দেশী, বিদেশী শব্দের ব্যবহার বেশি।
বর্তমানে চলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। সব মাধ্যমে চলিত ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে এবং দিন দিন এই ভাষা নতুন নতুন পরিবর্তনকে গ্রহণ করে আরো সাবলীল ও শাণিত হচ্ছে।
উপরের সাধু ভাষার উদাহরণগুলো নিম্নে চলিত ভাষায় পরিবর্তন করে দেখানো হচ্ছে।
১. এ যুগে বাংলাদেশে পশ্চিম হতে আসা আর্য জাতির সঙ্গে অনার্য জাতির সংস্রাব ঘটে। ফলে বাংলার আদিম অধিবাসী কোল জাতি আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি ক্রমশ গ্রহণ করে। অন্যদিকে তাদের দ্বারা আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি সামান্য পরিমাণে প্রভাবান্বিত হয়।
২. শরীর ও মনের যেরকম নিকট সম্বন্ধ তাতে শরীরের উন্নতির প্রতি সবার আগে লক্ষ রাখা উচিত। মানুষের শরীরও কলের মত। বেশি দিন শরীর না চললে এতেও মরচে ধরে, আর বেমি শক্তিতে বেশি খাটালে এরও কল বিগড়ে যায়, ঠিক সময়ে দম দিলে যেমন ঘড়ি অনেক দিন চলে তেমনি নিয়মিত শ্রমের ফলেও মানুষের শরীর অনেক দিন টেকে।
৩. মানব সমাজের যে দিকে ও যে স্তরেই তাকাই, সে দিকে কেবল অধর্মেরই পূর্ণ প্রসার দেখতে পাই, কেবল নিজের সংসারটি বজায় রাখার জন্য, পেট ভরাবার জন্য লোকে দিনরাত অধর্ম করে বেড়াচ্ছে। মিথ্যে কথা বলছে, চুরি জুয়াচুরি ডাকাতি করছে। লাঠালাঠি, খুনোখুনি, রক্তারক্তি করছে। আপাত মধুর ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে।
সাধু থেকে চলিত ভাষার রূপান্তরের নিয়মাবলী: বর্তমানে আর সাধু ভাষায় লেখা হয় না বললেই চলে। সাধু ভাষা টিকে আছে ঐতিহ্য হিসেবে বা ইতিহাসের অংশ হিসেবে। তবু পুরানো গ্রন্থাদির লেখা বর্তমান সময়ের পাঠকের বোধগম্য করার জন্য সাধু ভাষার সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ভাষা থেকে চলিত ভাষার রূপান্তরের নিয়মাবলী জানা জরুরি।
সাধারণত ধারণা করা হয় যে, সাধু ভাষার সর্বনাম, ক্রিয়া, অব্যয়পদ, অনুসর্গ, তৎসম শব্দ, সমাসবদ্ধ পদ সংক্ষিপ্ত করে ব্যবহার করলেই তা চলিত রূপান্তরিত হয়। কথাটি আংশিক সত্য। চলিত ভাষায় অনেক বাংলা শব্দও পরিবর্তন হয় এবং মুখের ভাষার গুরুত্ব দেয়া হয়। সেজন্য এই পরিবর্তন দিন দিন বাড়ছে। প্রমথ চৌধুরী বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চলিত ভাষা এখন আর ব্যবহৃত হয় না। সেই উদ্ভবকালের চলিত ভাষার এখন ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
সাধু থেকে চলিতের কিছু প্রয়োজনীয় উদাহরণ–
সমাপিকা ক্রিয়ার রূপের পার্থক্য:
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
যাইতেছি | যাচ্ছি | করিতেছি | করছি |
হইতেছে | ঘচ্ছে | বলিতেছে | বলছে |
গিয়াছেন | গিয়াছেন | খাইয়াছি | খেয়েছি |
বলিয়াছেন | ঊলেছেন | করিয়াছেন | করেছেন |
করিতেছিলাম | করছিলাম | হইতেছিল | হচ্ছিল |
পারিতাম | পারতাম | করিতাম | করতাম |
যাইবেন | যাবেন | খাইবেন | খাবেন |
করিও | করো | বলিও | বলো |
হইও | ঘয়ো | যাইও | যেও |
প্রযোজক ক্রিয়ার উদাহরণ:
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
বলাইলেন | বলালেন | করাইলেন | করালেন |
খাওয়াইলেন | খাওয়ালেন | খাওয়াইও | খাইয়ো |
শুনাইয়াছ | শুনিয়েছ | দিয়াছ | দিয়েছ |
পরাইয়াছ | পরিয়েছ | করাইছ | করিয়েছ |
অসমাপিকা ক্রিয়ার উদাহরণ:
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
যাইয়া | গিয়ে | যাইতে | যেতে |
করিতে | করতে | বলিয়া | বলে |
বলিতে | ঊলতে | বলিলে | বললে |
হইতে | হতে | বলিবার | বলবার |
খাইতে | খেতে |
যৌগিক ক্রিয়াপদের উদাহরণ:
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
গ্রহণ করা | নেওয়া | নিদ্রা যাওয়া | ঘুমানো |
শয়ন করা | শোওয়া | লাফ দেয়া | লাফানো |
আগমন করা | আসা | মুন্ডন করা | মোড়ানো |
চর্বণ করা | চোষা |
সর্বনাম পদের উদাহরণ:
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
তাঁহারা | তাঁরা | তাহাদের | তাদের |
যারা | যা | যাহার | যার |
কাহার | কার | কাহার | কার |
তাহার | তার | কাহাদের | কাদের |
ইহা | এ/এটা/এটি | ইহারা | এরা |
উহারা | ওরা | ইহাদের | এদের |
উহাদের | ওদের | ইহার | এর/এটার/এটির |
উহা | ও/ওটা/ওটি |
বর্তমানে বক্তৃতা বা সংলাপে উনার, উনাদের, তিনাদের, উনি প্রভৃতি শব্দ ব্যাকরণ-শুদ্ধ নয়।
অনুসর্গের উদাহরণ: সাধু ভাষার অনুসর্গ চলিত ভাষায় সংক্ষিপ্ত হয় এবং কখনো কখনো সম্পূর্ণ নতুন শব্দে পরিবর্তিত হয়।
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
ভিতরে | ভেতরে | থাকিয়া | থেকে |
ধরিয়া | ধরে | হইতে | হতে |
চাইতে | চেয়ে | পার্শ্বে | পাশে |
অপেক্ষা | চেয়ে | ন্যায় | মতো |
দ্বারা | দিয়ে | ব্যতীত | ছাড়া |
হইতে | থেকে | পন্ডাতে | পেছনে |
প্রতি | দিকে | সর্বাপেক্ষা | সবচেয়ে |
তদপেক্ষা | তার চেয়ে | ইহা দ্বারা | এর দিয়ে |
অব্যয়পদের উদাহরণ:
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
কুত্রাপি | কোথাও | যদ্যপি | যদিও |
তথাপি | তবুও | সহসা | হঠাৎ |
কদাচ | কখনো | নচেৎ | নইলে |
বরঞ্চ | বরং | অদ্যাপি | আজও |
বর্তমানে চলিত ভাষায় কেউ কেউ সাধু ভাষার অব্যয়পদ ব্যবহার করে।
সমাসবদ্ধ শব্দের উদাহরণ: চলতি ভাষায় দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার সংকুচিত করা হয়। চলিত ভাষায় সমাসবদ্ধ পদ আলাদা করে সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হয়।
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
কাষ্ঠনির্মিত | কাঠের তৈরি | সংগীত শ্রবণ লিপ্সা | গান শোনার ইচ্ছে |
কিয়ৎক্ষণে | কয়েক মুহুর্তে | বহু দিনান্তরে | বহু দিন পরে |
ডনবেদন পূর্বক | ডনবেদন করে | আজ্ঞা প্রাপ্তিক্রমে | আদেশ পাবার পর |
সন্ধিবদ্ধ শব্দের উদাহরণ: সমাসব্ধ শব্দের মত সন্ধিবদ্ধ বৃহৎ শব্দ চলিত ভাষায় সংক্ষিপ্ত করে লেখা হয়।
সাধু | চলিত | সাধু | চলিত |
তন্নিমিত্ত | তার জন্য | প্রত্যুত্তরে | তার উত্তরে |
তদ্দর্শনে | তা দেখে | মনস্কামনা | মনের ইচ্ছে |
তদুপরি | তার উপরে | প্রথানুসারে | প্রথা অনুসারে |
উপরোক্ত উদাহরণের বাইরে আরো অনেক পরিবর্তন ও প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। বিশেষ্য, বচন, কারক, বিভক্তির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়।
সার্বিকভাবে বলা যায়, সাধু থেকে চলিত ভাষায় পরিবর্তন করার সময় উপরোক্ত বিষয়গুলো লক্ষ রাখা ছাড়াও আরো কিছু বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। চলিত ভাষায় দীর্ঘদিন লিখতে লিখতে এর একটি আদর্শরূপ দাঁড়িয়ে গেছে এবং তা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। সাধু ভাষার তৎসম শব্দ, ক্রিয়া, সর্বনাম, অব্যয়, সমাসবদ্ধ পদ, অনুসর্গ, সন্ধিযুক্ত শব্দ সংক্ষিপ্ত ও প্রয়োজনমত পরিবর্তন করলে চলিত ভাষার রূপান্তর হয়ে যায়। রূপান্তরের সময় মনে রাখতে হবে শব্দগুলো যেন চলিত-প্রমিত হয়, দুর্বোধ্য না হয়, অপ্রচলিত না হয়।